শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর? তিনি তো জন্ম গ্রহণ করেছিলেন? ঈশ্বরের কি জন্ম মৃত্যু থাকতে পারে?
![]() |
পরমেশ্বর ভগবান শ্রী নারায়ণ |
পিতা অহম্ অস্য জগতঃ মাতা ধাতা পিতামহঃ।বেদ্যম্ পবিত্রম্ ওঙ্কার ঋক সাম্ যজুঃ এব চ।।
জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্ এবম্ যঃ বেত্তি তত্ত্বতঃ।ত্যাক্তা দেহম্ পুনঃ জন্ম ন এতি মাম এতি সঃ অজৃুন।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা~ ৪/৯)
অর্থাৎ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ও কর্ম মানুষের জন্ম ও কর্মের মতো লৌকিক এবং পার্থিব নয়, তা অলৌকিক এবং চিন্ময়। ঈশ্বরের কোনো জন্ম মৃত্যু নেই এটা ঠিক; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তিনি জন্ম লীলা প্রকাশ করতে পারেন না। এমন নয় যে, আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, এবং তার আগে তিনি ছিলেন না। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম লীলাকে আশ্রয় করে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বা প্রকট হয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় (৪/৬) তিনি বলেছেন,
অজ অপি সন অব্যয় আত্মা ভূতানাম্ ঈশ্বর অপি সন।
প্রকৃতিম্ স্বাম অধিষ্ঠায় সম্ভবামি আত্মমায়য়া।।
অর্থাৎ, যদিও আমি জন্মরহিত, অবিনশ্বর এবং সর্ব ভূতের ঈশ্বর তবুও আমার স্বীয় প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করে আমি আমার মায়া শক্তির দ্বারা আবির্ভূত হই।।
আর্য নামধারী অগ্নিবীর জঙ্গি সংগঠন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে শুধু একজন মহাপুরুষ বা যোগীদের ঈশ্বর যোগেশ্বর ছাড়া স্বয়ং ঈশ্বর বলে স্বিকার করতে চায়না। এই প্রসঙ্গে ভগবান বলেছেন --
অবজানন্তি মাং মুঢ়া, মানুষীং তনুমাশ্রিতম্, পরং ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্।
অর্থাৎ , আমি যখন মানুষ রূপে অবতীর্ণ হই তখন, মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে, তারা আমার পরম ভাব সম্পর্কে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।
এবং মহাভারত ও গীতা রচয়িতা মহামুণি কৃষ্ণ দৈপায়ণ বেদব্যাস/ব্যাসদেব শ্রীমদ্ভাগবতম পুরানে(১০/১২/১১) বলেছেন ---
বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সেই পরম ব্যাক্তি যাঁকে মহান মুনিঋষিরা নির্বিশেষ ব্রহ্ম রূপে জানেন এবং সাধারণ মানুষেরা জড়া প্রকৃতির সৃষ্টি বলেই মনে করেন।
শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৪/৫৫) আরও বলেছেন--
এই কৃষ্ণকে সমস্ত আত্মার পরমাত্মা বলে জেনো। জগতের মঙ্গলের জন্য সেই তিনিই পরম ব্যাক্তি হয়েও এখন সাধারণ মানুষের মতো প্রকাশিত হয়েছেন যোগমায়াকে আশ্রয় করে।
এইভাবে তিনি যুগে যুগেই অবতীর্ণ হন। তবে, এইভাবে যুগে যুগে অবতীর্ণ হলেও তিনি কিন্তু অযোনিসম্ভবা। অর্থাৎ, তাঁর জন্ম, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্মের মতো নয়। তিনি বসুদেবজী এবং দেবকীজীর হৃদয়ে চতুর্ভুজ রূপে প্রকাশমান হয়েছিলেন এবং তারপর শিশু রূপ পরিগ্রহ করে তাদের কোল আলোকিত করে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
অর্থাৎ, মানুষের মতো মাতৃগর্ভে প্রবেশ করার মাধ্যমে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন নি, তিনি জন্ম লীলাকে আশ্রয় করে এই পৃথিবীতে নিজেকে প্রকট করেছিলেন। কিন্তু তিনি জন্ম লীলাকে আশ্রয় করলেও জন্মজন্মান্তরের মায়া তাকে মোহিত করতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৪/৫) তিনি অর্জুনকে বলেছেন,
বহুনী মে ব্যতীতানি জন্মানি তব অর্জুন।
তানি অহম্ বেদ সর্বানি ন ত্বম্ বেত্থ পরন্তপ।।
অর্থাৎ, এর আগে তোমার ও আমার বহু জন্ম অতিবাহিত হয়েছে পার্থ। তোমার মনে নেই, কিন্তু আমার মনে আছে।
প্রশ্ন হতে পারে ভগবান যদি সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন তবে তিনি তো এমনিতেই প্রকট হতে পারেন, জন্মলীলাকে কেন আশ্রয় করতে হয়?
ভগবান ইচ্ছাময়, তিনি জন্মলীলাকে আশ্রয় না করেও প্রকট হতে পারেন, তার প্রমাণ হল ভগবানের নৃসিংহ অবতার, যে অবতারে তিনি শুধুমাত্র একটি স্তম্ভের ভিতর থেকেই প্রকট হয়েছিলেন।
বামন অবতার রূপে, মৎস্য, কূর্ম ও বরাহ রুপেও প্রকট হয়েছিলেন।।
ভগবান হলো ইচ্ছাময় তিনি কিভাবে কি অবতার রূপে আসবেন বা প্রকট হবেন এবং কিভাবে দুষ্টের দমন ও ভক্তেদের সাথে লীলা করবেন সেটা তার ইচ্ছা।।
বসুদেবজী, দেবকীজী, নন্দ মহারাজ, যশোদা মাতা প্রমুখ ব্যাক্তিরা হলেন ভগবানের বাৎসল্য প্রেমের ভক্ত। অর্থাৎ অজ্ঞ ব্যাক্তিরা যাঁদেরকে ভগবানের জন্মদাতা বা পিতামাতা মনে করেন আসলে তাঁরা ভগবানের জন্মদাতা বা পিতামাতা নন। তাঁরা ভগবানের বাৎসল্য প্রেমের ভক্ত। কারণ, ভগবানের কোনো জন্মদাতা নেই, তিনি অজ। তাঁকে কেউ জন্ম দেননি বা সৃষ্টি করেন নি। তিনি অনাদি।
অনুগ্রহায় ভক্তনাং মানুষং দেহমাশ্রিতঃ (শ্রীমদ্ভাগবত~১০/৩৩/৩৬)
যে ভক্ত যে ভাব নিয়ে ভগবানকে ভজনা করেন, ভগবানও তাকে ঠিক সেই ভাবেই অনুগ্রহ করেন।
ভক্তি মার্গের ভক্তরা মূলত ৫টি ভাবকে আশ্রয় করে ভগবানের ভজনা করে থাকেন। সেই ভাব ৫টি হলো শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধূর।এই ৫টি ভাবের মধ্যে শুধুমাত্র শান্ত ভাবের ভক্তরাই ভগবানকে ষড়ৈশ্বর্যময় ঈশ্বর জ্ঞানে উপাসনা করেন। এঁরা সাধারণত ভগবানের চতুর্ভুজ রূপের আরাধনা করেন। শান্ত ভাবের প্রধান পাত্রগণ হলেন সনকাদি ঋষিগণ।
অন্য দিকে দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর ভাবের ভক্তরা এই ৪টি ভাবের যেকোনো একটি ভাবকে আশ্রয় করে ভগবানের সঙ্গে অপ্রাকৃত এবং দিব্য সম্বন্ধে সম্বন্ধ যুক্ত থাকেন। এঁরা ভগবানের মাধুর্যময় শ্যামসুন্দর দ্বিভুজ রূপের ভজনা করে থাকেন। এঁরা কখনোই ভগবানের প্রতি সম্ভ্রম বা সংকোচ ভাব পোষণ করেন না। কারণ এঁরা ভগবানকে একান্ত আপনজন বলে মনে করেন। অবশ্য দ্বারকালীলার ভক্তদের প্রেম ঐশ্বর্য মিশ্রিত। ।
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে, তাংস্তথৈব ভজম্যহম।
মম বর্ত অনুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা~৪/১১)
হে পার্থ, যে যেভাবে আমার প্রতি আত্ম সমর্পন করে প্রপত্তি স্বীকার করে,আমি তাকে সেইভাবেই পুরুষকৃত করি। মনুষ্য গণ সকলেই সর্বতেভাবে আমারই অনুসরন করে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন --
হে পার্থ, আমি এই জড়জগতে মনুষ্য রূপে অবতীর্ণ হলেও জড়া-ব্যাধি, রোগ-শোক ও বার্ধক্য ইত্যাদির দ্বারা আমি কখনোই প্রভাবিত নই।।
এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভাগবতে(১/১১/৩৮) বেদব্যাস বলেছেন,
ঈশ্বর প্রকৃতিতে আছেন তবুও প্রকৃতির গুণ তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না; এইখানেই ঈশ্বরের ঈশ্বরত্ব এবং মৃত্যু যে তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না যে কথা তো বলাই বাহুল্য, কারণ তাঁর দেহটি আমাদের দেহের মতো জড় দেহ নয়। তাঁর দেহটি হলো চিন্ময় দেহ।
শ্রীমদ্ভাগবত ও মহাভারতের মৌশল পর্বের (অধ্যায় ৪,৬,১০) বর্ণনা অনুযায়ী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজের ইচ্ছায় এক ব্যাধের দ্বারা তীর বিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে তাঁর অন্তধান লীলা সমার্পন করেছেন। জড়া নামক এক ব্যাধ ভ্রমবশত শ্রীকৃষ্ণকে শরবিদ্ধ করে অনুশোচনা করতে থাকলে, শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, হে জরা ভয় পেও না। তুমি যা করেছো তা আমার ইচ্ছেতেই সংঘটিত হয়েছে। এতে তোমার কোনো অপরাধ নেই।
আজকের তারিখে একটা বড় অংকের মানুষ যে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলে স্বীকার করবেন না, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কারণ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন পৃথিবীতে সাক্ষাৎ উপস্থিত ছিলেন, তখনও একদল মানুষ তাঁকে সাধারণ মানুষ বা মহাপুরুষ বলেই মনে করতেন।
এমনকি তাঁর ঐশ্বর্যময় রূপ দর্শন করেও অনেকেই তাঁকে চিনতে পারেন নি।
তার প্রমাণ, দুর্যোধন দুঃশাসন অঙ্গরাজ কর্ণ ও শিশুপাল।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হবার আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন শান্তির বার্তা নিয়ে কুরু রাজসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন তখন দুর্যোধন, দুঃশাসনরা তাঁকে বন্দি করতে উদ্ধত হলে ভগবান ষড়ৈশ্বর্যময় চতুর্ভুজ বিষ্ণু রূপ ধারণ করেছিলেন।
কিন্তু দুর্যোধনরা শ্রীকৃষ্ণের সেই ঐশ্বর্যময় রূপ দর্শন করা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণকে ভগবান বলে স্বীকার করেন নি বা সেই উপলব্ধিই তাদের হয় নি। কারণ ভগবানকে উপলব্ধি করার একমাত্র অবলম্বন হলো ভক্তি, যার লেশ মাত্র দুর্যোধনদের হৃদয়ে ছিলো না।
দুর্যোধন ও শিশুপালের মতো ব্যাক্তিরা প্রশ্ন তোলেন যে,
যিনি ১৬১০৮ জন রমণীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন , তিনি আর যাইহোন না কেন ভগবান হতে পারেন না।
কিন্তু তাদের এটা জেনে রাখা উচিত যে, শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে ১৬১০৮টি রূপে প্রকাশিত করে একই সময়ে একই লগ্নে ১৬১০৮ টি আলাদা আলাদা বিবাহ মন্ডবে উক্ত রমণীগনকে একত্রে বিবাহ করেছিলেন, যেটা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অথবা যারা গোপীদের বস্ত্র হরণ লীলা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাদেরও এটা জেনে রাখা উচিত যে, যে শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের সঙ্গে বস্ত্র হরণ লীলা করেছিলেন সেই শ্রীকৃষ্ণই ৫-৬ বছর বয়সে তাঁর কনিষ্ঠাঙুলে বিশাল গোবরধন পর্বতকেও ধারণ করেছিলেন কয়েকদিন নাগাদ এবং জন্মর। পর পরই অসংখ্য ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর রাক্ষস রাক্ষসীকে বধ করেন কোনো অস্ত্র বা মায়া ছাড়াই।।
You May Also Like :
3. কিভাবে ফেসবুক একাউন্ট ডিলিট করবেন ?
4. কিভাবে ফেসবুকের ভিডিও ডাউনলোড করবেন ১ মিনিটেই ?
5. Create your logo with professional logo designer
Join Our Facebook Community:👇