চলুন জেনে নিই একাদশী পালনের শাস্ত্রীয় বিধি-নিয়ম এবং পারণ মন্ত্র | একাদশী পালন না করলে কি হয়?
একাদশী একটি চান্দ্র তিথি। চাঁদের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথি, হিন্দু ধর্মমতানুসারে পুণ্যতিথি হিসেবে বিবেচিত। হিন্দুধর্মমতে নিরম্বু উপবাস বিহিত। একাদশী ব্রত অবশ্য পালনীয়। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তার লীলাবিলাসের প্রথম থেকেই "একাদশী উপবাসের" প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। শ্রীল জীব-গোস্বামী তার ভক্তিসন্দর্ভ গ্রন্থে স্কন্ধ পুরাণের একটি উদ্ধৃৃতি দিয়ে বলেছেন,
যে মানুষ একাদশী পালন না করে একাদশীর দিন শস্যদানা, অন্ন গ্রহণ করে সে তার পিতা, মাতা, ভাই এবং গুরু হত্যাকারী, সে যদি বৈকুণ্ঠ লোকেও উন্নীত হয়, তবুুুুও তার অধঃপতন হয়়।
এসময় সাধারণত ফলমূল ও বিভিন্ন সবজি এবং দুধ খাওয়া যায়, তবে একাদশীতে পঞ্চরবি শস্য বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। বিষ্ণুর শয়ন, পার্শ্ব পরিবর্তন ও উত্থান উপলক্ষে যথাক্রমে আষাঢ়, ভাদ্র ও কার্তিক মাসের শুক্লা একাদশী বিশেষ শুভপ্রদ গণ্য করা হয়। ভৈমী একাদশী ও মাঘের শুক্লা একাদশীকেও বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। নিয়মিত একাদশী পালন শরীরের পক্ষেও উপকারী। তাই স্বাস্থ্যগত কারণেও অনেকে প্রতি মাসে দুটি একাদশী তিথি পালন করেন।
✅একাদশী পালনের নিয়ম—
একাদশীর মূল কাজ হল– নিরন্তর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের তথা নারায়ন এর স্মরণ করা। তাই আপনারা যে নিয়মে, যে সময়ে পালন করুন না কেন, ভগবানকে ভক্তিভরে স্মরণ করাই যেন আপনার মূল কাজ হয়।
#১ একাদশী পালনের সাত্ত্বিক নিয়মগুলো হলো—
✓ সমর্থন ব্যক্তি দশমীতে একাহার(দিনে একবার আহার), একাদশীতে নিরাহার(নির্জলা), ও দ্বাদশীতে একাহার করতে হবে।
✓ যদি তা না পারেন তবে শুধুমাত্র একাদশীতে অনাহার(২৪ ঘণ্টা কিছুই না খেয়ে)।
✓ যদি উহাতেও অসমর্থ হন, একাদশীতে পঞ্চ রবিশস্য বর্জন করে ফলমূলাদি অনুকল্প গ্রহণের বিধান রয়েছে।
#১ বিঃ দ্রঃ
✓ সমর্থন ব্যক্তির পক্ষে রাত জাগরণের বিধি আছে, গৌড়ীয় ধারায় বা আচার্যবৃন্দের অনুমোদিত পঞ্জিকায় যে সমস্ত একাদশী নির্জলা (জল ব্যতীত) পালনের নির্দেশ প্রদান করেছেন, সেগুলি সেই মতে পালন করলে সর্বোত্তম হয়।
✓ নিরন্তর কৃষ্ণভাবনায় থেকে নিরাহার থাকতে অসমর্থ হলে নির্জলাসহ অন্যান্য একাদশীতে কিছু — সবজি, ফলমূলাদি গ্রহণ করা যেতে পারে । যেমন — গোল আলু, মিষ্টি আলু, চাল কুমড়ো, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি অথবা বাদাম তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে উৎসর্গ করে আহার করতে পারেন।
হলুদ, মরিচ, ও লবণ ব্যবহার্য।
আবার অন্যান্য আহার্য, যেমন — দুধ, কলা, আপেল, আঙুর, আনারস, আখ, আমড়া শস্য, তরমুজ, বেল, নারিকেল, মিষ্টি আলু , বাদাম ও লেবুর শরবত ইত্যাদি ফলমূলাদিও খাওয়া যেতে পারে ।
#২ একাদশীতে পাঁচ প্রকার শস্যদানা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে—
✓ ধানজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – চাউল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েস, খিচুড়ি, চালের পিঠা, খৈ ইত্যাদি।
✓ গমজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – আটা, ময়দা, সুজি, বেকারির রুটি , বা সকল প্রকার বিস্কুট, হরলিকস ইত্যাদি ।
✓ যব বা ভুট্টাজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — ছাতু, খই, রুটি ইত্যাদি ।
✓ ডালজাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — মুগ, মাসকলাই, খেসারি, মসুরি, ছোলা অড়হর, ফেলন, মটরশুঁটি, বরবটি ও সিম ইত্যাদি ।
✓ সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, তিলের তেল ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পঞ্চ রবিশস্যের যেকোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয়।
#২ বিঃ দ্রঃ
✓ উল্লেখ্য যারা সাত্ত্বিক বা নিরামিষ আহারী নন এবং চা, বিড়ি/সিগারেট, পান, কফি ইত্যাদি নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন, একাদশী ব্রত পালনের সময়কাল পর্যন্ত এগুলি গ্রহণ করবেন না।
✓ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, একাদশী করলে যে কেবল নিজের জীবনের সদ্গতি হবে তা নয়। একাদশী পালন করা ব্যক্তির প্রয়াত পিতা/মাতা যদি নিজ কর্ম দোষে নরকবাসী হন, তবে সেই পুত্রই (একাদশী ব্রত) পিতা–মাতাকে নরক থেকে উদ্ধার করতে পারে এবং জন্ম মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত তথা মোক্ষ লাভ করে ভগবান শ্রী নারায়নের পরম ধাম প্রাপ্ত হয়।
✓ একাদশীতে কেউ অন্ন ভোজন করলে যেমন নরকবাসী হবে, অন্যকে ভোজন করালেও নরকবাসী হবে।তাই আপনি যদি একাদশী পালন করেন তবে আপনার সন্তান বা পিতা-মাতার জন্য ভাত(অন্ন) রান্না করা যাবেনা।
#৩ বিঃ দ্রঃ
✓ একাদশী পালনের পরনিন্দা, পরচর্চা, সমালোচনা, সংসার বিষয়ে কারো সাথে আলাপ করা, মিথ্যা ভাষণ, ক্রোধ, দুরাচার, স্ত্রী সহবাস সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ।
✓ একাদশী ব্রতের আগের দিন রাত ১২ টার আগেই অন্ন ভোজন সম্পন্ন করে নিলে সর্বোত্তম। এবং তখনি ঘুমানোর আগে দাঁত মেজে নিন কারণ একাদশীর দিন টুথপেস্ট বা অন্যান্য সকল দাঁত মাজার রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
রাতে ব্রাশ করে দাঁত ও মুখগহবরে লেগে থাকা সব অন্ন পরিষ্কার করে নেওয়া সর্বোত্তম। সকালে উঠে শুধু মুখ কুলি ও স্নান করতে হয়।
✓ একাদশীতে সবজি কাটার সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন কোথাও কেটে না যায়। একাদশীতে রক্তক্ষরণ বর্জনীয়। দাঁত মাজার সময় অনেকের রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। তাই একাদশীর আগের দিন রাতে দাঁত ভালোভাবে মেজে নেওয়াই উত্তম।
✓ একাদশীতে চলমান একাদশীর মাহাত্ম্য ভগবদ্ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রবণ অথবা নিজেই ভক্তি সহকারে পাঠ করতে হয়।
✓ যারা একাদশীতে একাদশীর প্রসাদ রান্না করেন, তাদের পাঁচফোড়ন ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিৎ, কারণ পাঁচফোড়নে সরিষার তৈল ও তিল থাকতে পারে যা বর্জনীয়।
✓ একাদশীতে শরীরে প্রসাধনী ব্যবহার নিষিদ্ধ। তৈল (শরীরে ও মাথায়) সুগন্ধি, সাবান, শ্যাম্পু ইত্যাদি বর্জনীয়।
✓ সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম — দাড়ি-গোঁফ এবং চুল ও নখ কাটা নিষিদ্ধ।
✅একাদশীর পরের দিন পারণের নিয়ম—
#৩ একাদশীর সংকল্প মন্ত্রঃ এবং পারণ মন্ত্র:
"একাদশ্যাং নিরাহারঃ স্থিত্বা অহম অপরেহহানি, ভোক্ষ্যামি পুন্ডরিকাক্ষ শরণম মে ভবাচ্যুত" (হরিভক্তিবিলাস, ত্রয়োদশবিলাস)
একাদশীর পারণ মন্ত্রঃ
"অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য ব্রতেনানেন কেশব, প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব" (বৃ: না: পু: ২১/২০)
অথবা
"একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব, প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব"
একাদশী পারণঃ (একাদশী তিথির পরদিন উপবাস ব্রত ভাঙার পর নিয়ম) পঞ্জিকাতে একাদশী পারণের (উপবাসের পরদিন সকালে) যে নির্দিষ্ট সময় দেওয়া থাকে, সেই সময়ের মধ্যে পঞ্চ রবিশস্য ভগবানকে নিবেদন করে, প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করা একান্ত দরকার।
নতুবা একাদশীর কোন ফল লাভ হবে না। একাদশী ব্রত পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কেবল উপবাস করা নয়, নিরন্তর শ্রীভগবানের নাম স্মরণ, মনন, ও শ্রবণ কীর্তনের মাধ্যমে একাদশীর দিন অতিবাহিত করতে হয় ।
✓তথ্যসূত্র:
- শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত (আদিলীলা ১৫/৮-১০)
- রঘুনন্দনের একাদশীতত্ত্ব
- ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শ্রীভীমসেন-ব্যাস সংবাদ
- ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদ
You Might Also Like :
1. ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি -এ বছর কত তারিখে জন্মাষ্টমী উদযাপন হবে?
2. সত্যি কি হযরত মুহাম্মদ সনাতন ধর্মের কল্কি অবতার?
3. বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ কি ঈশ্বর? এর কি শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে?
4. Google Adsense Approval Tips 2022 | How to get google adsense approval fast
5. How To Create Payoneer Account | Payoneer $25 Bonus